শাস্তির বদলে পদোন্নতি: সেই রফিক এখন কুমিল্লার জেলা শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত ডিডি

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন বিতর্কিত সেই কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভাইয়ের সম্পৃক্ততাসহ দাপ্তরিক বিভিন্ন অনিয়ম-অপরাধে অভিযুক্ত এই কর্মকর্তার নিয়োগ ও পদায়ন ইতোপূর্বে নানা অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয়াদির বিভাগীয় তদন্ত ও প্রতিবেদনে রফিকুল ইসলামের অতীত কর্মকান্ডের তথ্য-প্রমাণ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরপরও তাকে কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে আসীন করা হলো- এমন প্রশ্নে ক্ষোভে ফূঁসে উঠছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহের তৎকালিন জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলায় শিক্ষা অফিসার পদে তিন বছরের অধিক কর্মরত ছিলেন এবং জনসম্পৃক্ততা ছিল অতিমাত্রায়। ফলে, জনস্বার্থে তাকে অন্যত্র বদলি করা সমীচীন বলে তদন্ত কর্মকর্তারা দৃঢ়ভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমটির প্রতিবেদনের পরও তিনি আরো চার বছর ময়মনসিংহেই স্বপদে বহাল ছিলেন। এখন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। সেই রফিকুল ইসলাম এখন কুমিল্লার জেলা শিক্ষা অফিসার। একইসঙ্গে উপ-পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে।

জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে মন্ত্রাণালয় রফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করার সুনির্দিষ্ট ধারা উল্লেখসহ প্রস্তাব পাঠাতে মাধ্যমিক ও ওই উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়াও রফিকুলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করার অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরনী পাঠাতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু অধিদপ্তরের সরকারি মাধ্যমিক শাখার সিন্ডিকেটের কবলে ফাইল চাপা রয়েছে।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শাহীনুর ইসলাম স্বাক্ষরিত তাগিদপত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পৌঁছালেও অদ্যাবধি কোনো অগ্রগাতি দেখা যায়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রফিকুল ইসলাম ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসার থাকাকালে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে লিপ্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যমতে, ত্রিশাল উপজেলার কাটাখালী উমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে। ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রফিকুল ইসরামের অপরাপর সঙ্গীরা ছিলেন-তৎকালীন ত্রিশাল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন।

জানা যায়, মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে ত্রিশাল উপজেলার কাটাখালী উমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মাধ্যামিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে এ তথ্য জানা যায়।

অভিযোগ ছিলো, রফিকুলের সিন্ডিকেট ও ওই স্কুলটির প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী গ্রন্থাগারিক ও নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটারঅপারেটর নিয়োগে বাণিজ্য করে আর্থিক লাভবান হয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদে ম্যানেজিং কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। এ নিয়োগের সময় প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা চলমান ছিলো।কিন্তু জেলা প্রশাসকের সুপারিশ মানা হয়নি।

২০১৯ সালের ১৮ মার্চ আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান। মহাপরিচালক ওই প্রতিবেদনটি শিক্ষা সাচিবকে পাঠান ওই বছরের ২২ আগস্ট। প্রতিবেদনে জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলামের কাছে নিয়োগ, ম্যানেজিং কমিটিসহ কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগ জমা দিলেও তা তদন্ত না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা দেয়া থাকলেও ওই পদে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ প্রমাণ পায় কমিটি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ম্যানেজিং কমিটির, পাঁচজন সদস্য পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগও প্রমাণিত। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির শূণ্যপদ পূরণ না করে কমিটি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হতে পারে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রধান শিক্ষক হিসেবে মো. আফাজ উদ্দিনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি ধানীখোলা ওসমানীউ উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চ্চা শিক্ষক এবং শিক্ষা জীবনে দুইটি তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। সভাপতির আপন চাচাতো ভাই তিনি। নিম্নমান সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সভাপতির আপন ছোট ভাই শহীদুর রহমানকে।

জানা গেছে, অভিযুক্ত রফিক মনোহরদী উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক ক্যাডার এবং তার একমাত্র বড় ভাই প্রায়াত শফিকুল ইসলাম কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক অন্যতম নেতা এবং ডা. মিলন হত্যার় অন্যতম আসামি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি পুত্র মুন্না হত্যার অন্যতম আসামি।

আরও জানা গেছে, এই রফিকুল ইসলামের নামে নরসিংদী সদর থানায় এবং নরসিংদীর বিজ্ঞ মাজিস্ট্রেট আদালতে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রফিকের একজন সাবেক সহকর্মী বলেন, ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালনকালিন সময়ে তার দাপটে অতিষ্ঠ থাকতো অফিসের অন্য সহকর্মীরা। নিয়োগ-বদলি নিয়ে নানা অনিয়ম ও সেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত থাকলেও তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না। তবে তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে এবং তা কুকর্মের প্রমান পাওয়া গেছে। তারপরও তার প্রদায়ন থেমে নেই বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠো অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আইন অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার একজন প্রতিনিধি দিতে হয়, আমি সেটাই দিয়েছি। এখানে আমার কোনো হাত ছিলো না। এ বিষয়গুলো তদন্ত করে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

Share This Article